প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’র মেধাসত্ত্ব চুরি এবং ‘শিক্ষক’ ডক্টর রুহুল আমিনের মুখোশ উন্মোচন - প্রথম পর্ব
বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ মেধাসত্ত্ব নিয়ে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছিলেন শাবিপ্রবির (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন। মূল উদ্ভাবক বুরহান উদ্দিন ও আহমেদ চিশতীকে পাশ কাটিয়ে সকল কৃতিত্ব এবং অর্থ-নাম-যশ দখল করার ন্যাক্কারজনক গল্পের সকল বিস্তারিত আমরা এর আগে কখনো জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয় নি। ২০২১-এ একবার কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে ব্যাপারটিকে প্রকাশে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিভাগের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যারা ছিলেন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও এই বিষয়ে দুই বছরের বেশি সময়েও তেমন কিছুই করেননি- যাকে আমরা সদিচ্ছার অভাব বলে মনে করছি। তাই আমরা নিজেরাই জনসমক্ষে নিয়ে এসেছি মেধাসত্ত্ব চুরি এই ন্যাকারজনক ইতিহাসের বিস্তারিত।
আমরা আগেই বলে নিতে চাই, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা বা কাউকে মানহানি করা মোটেও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের এই মেধাসত্ত্ব চুরির ঘটনা অত্যন্ত মারাত্মক এবং আমরা গত দশ-বারো বছর এর ভুক্তভোগী। বাংলা ভাষার প্রথম সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকার যে ব্র্যান্ডিং, যে প্রচার প্রসার- যার কথা পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত আছে; তাতে নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের অন্যতম বড় অ্যাকাডেমিক চৌর্যবৃত্তির ঘটনা।
গত প্রায় এক যুগ এই ঘটনার ভুক্তভোগী আমরা। খুবই দুঃখের বিষয়, এই একই ধরণের ঘটনা এই ব্যক্তি বারবার ঘটিয়ে যাচ্ছেন; এমনকি এখনো! সম্প্রতি আরেকটি পোস্ট আমাদের চোখে আসে। এর বাইরে আরো বহুবার তার এই একই ধরণের কান্ডের খোঁজ পেয়েছি অনুজ এবং অগ্রজদের কাছ থেকে। খুবই দুঃখজনক যখন শুনি যখন কেউ খুব নিষ্ঠার সাথে কাজ করার পরেও তার কোনো কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কোনও কাজের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে যখন কাউকে বঞ্চিত করা হয়, তখন তাকে আসলে গবেষণা কাজে ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। আবার, যখন কেউ তার নিজের কাজের থেকে বেশি স্বীকৃতি দাবী করে বসে; সেটিও বাকিদের ভালো কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে।
বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী- যারা গবেষণায় আগ্রহী তাদের উচিত এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়া যাতে এই জাতীয় ‘প্রতারক শিক্ষক’ থেকে সতর্ক থাকা যায়।
সতর্ক না থাকলে যেটা হবে, সেটা হল- আপনি কষ্ট করবেন, অনেক খাটাখাটনি করবেন, কিন্তু দেখবেন দিন শেষে আপনার কাজ নিয়ে অন্য কেউ বাহ্বা নিচ্ছে কিংবা অনেক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যারা গবেষণার কাজে অনেক শ্রম দেন তারা বুঝবেন ব্যাপারটা কতখানি কষ্টকর হতে পারে।
মেধাস্বত্ব প্রতারণার নমুনা
তার মেধাসত্ত্ব প্রতারণা খুবই নির্বিষভাবে শুরু হয়। বিগত একযুগে বেশ কয়েকটা কাজে তিনি ‘শিক্ষক’ হিসেবে ঢুঁকে প্রতারক হিসেবে বেরিয়ে আসেন। যে সকল প্রোজেক্টে এরকমটা হয়; সে প্রোজেক্টগুলোতে একটা সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়ঃ প্রথমে তিনি পড়াশোনা, কাজ, প্রোগ্রামিং এ ভালো এমন কাউকে খুঁজে বের করেন। প্রচুর উৎসাহ দেন। শাবিপ্রবির সর্বোচ্চ সিজিপিএ ধারি হওয়ায়; বা অন্যান্য পরবর্তী কিছু কারণে খুব সহজেই সাস্টিয়ানরা তার সাথে গবেষণা করতে আগ্রহী হতেন, হন। তারপরে দেখা যায় খুব ভালো একটা প্রজেক্ট / ডাটাসেট / পেপার রেডি হয়। তারপর দেখা যায় একটি পেপার প্রকাশিত হয়েছে / প্রযুক্তির (যেমন: পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন) উদ্ভোদন হয়েছে; কিন্তু আসল কাজ করা কিছু মানুষ সব কিছু থেকে বাদ পড়ে গেছেন। বা তিনি শেষে ঢুকে মতামতের তোয়াক্কা না করে নেতা বনে গেছেন বা প্রথম অথার হয়ে বসেছেন।
যেহেতু কেউই শিশু নই; সবাই এটা বুঝতে পারে একটা সময় যে একজন শ্রদ্ধার স্থানে বসে থাকা ‘শিক্ষক’ তাদের সাথে কী অন্যায়টা করেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন কিছু করার থাকে না। এই ঘটনাটা আমাদের সাথেও ঘটেছে পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে; যার বিস্তারিত দেয়া আছে নীচে।
বোঝার পরে এটা নিয়ে বলার কিছু থাকে না, কারণ হয়তো সেই ছাত্রের ড্রপ কোর্স আছে, বা সামনে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় আবেদন করবে তাই থিসিস সুপার ভাইজারের রিকোমেন্ডেশন" লাগবে। এই নিয়ন্ত্রণের শেকল কেউ সহজে ভাঙতে পারে না। তাই নিশ্চুপে ব্যাপার টা চেপে যায়।
প্রথমবারের মত সত্য প্রকাশ
এই চেপে যাওয়ার ভুল কাজটা আমরা ২০১৩ সালে করেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন সজীব শুধু আমাদেরকে নিয়ে থেমে থাকছেন না, এই একই ঘটনা তিনি বার বার বার ঘটিয়েই যাচ্ছেন অন্য অনুজদের সাথে। এমনকি শাবিপ্রবির বাইরেও। তিনি অন্যের ঘাড়ে সওয়ার হন আর সব কাজ করে দেয়ার পরে দেখা যায় তিনি প্রজেক্ট নিয়ে কেটে পড়েছেন, বা নিজেই প্রথম বা সুপারভাইজরি অথর হয়ে গেছেন। কেউ প্রতিবাদ করে না।
তবে এই একই জিনিস বার বার হতে দেখে ২০২১ এ প্রথম আমরা যখন মুখ খুলেছিলাম উল্টো শাবিপ্রবি অ্যালামনাই গ্রুপে এই ‘শিক্ষক’ আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন এবং আমাদের দাবি ভিত্তিহীন দাবী করেন। যুক্তি খন্ডনের বদলে উল্টো ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য তিনি ‘একজন শিক্ষককে অপমান হয়রানি করা হচ্ছে’ বলে সিম্প্যাথি আদায় করার চেষ্টা করেন। যা আমরা এখন আবার অন্যদের সাথে করতে দেখছি তাকে। পরে তিনি আবার দাবি করেন তিনি কখনই আমাদের প্রজেক্টটিতে প্রথম অথার দাবি করেন নি। পরে তিনি আরো সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আমাদের আক্রমন করেন এবং ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে সাস্টের ভূতপূর্ব ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন সজীবের মিথ্যাচার; অপকর্ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অ্যাকাডেমিক অসৌজন্যতার ইতিহাস তুলে ধরছি আমরা এখানে। একসাথে পড়লে পুরোটাই একটা পূর্ব পরিকল্পিত ডাকাতির মত; উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটা প্রযুক্তির মেধাসত্ত্ব এবং খ্যাতি আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে।
রুহুল আমিন সজীবের কুকীর্তির সার সংক্ষেপ
-
একেবারে শুরুতে আমাদের প্রজেক্ট বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা আমাদেরকে না জানিয়ে বিজ্ঞান মেলায় অন্যদের দিয়ে প্রদর্শন করান, ১ম পুরস্কার পাওয়ার পরে অনুষ্ঠানের সব কিছুর শেষে আমাদের জানান। যেখানে উনি নিজে এসে আমাদের প্রজেক্টের মাঝে ঢুকেছেন সুপারভাইজার হয়ে, সেখানে ১ম পুরস্কারের মেডেল নিয়ে জাফর ইকবালের সামনে যেয়ে, আমরা; যারা দুজন ইনভেন্টর; তাদের এই প্রজেক্টে কাজ করা ছাত্রমাত্র হিসেবে পরিচয় দেওয়া।
-
পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন গনম্যাধমের আকর্ষণ পেতে শুরু করার সাথে সাথে গনম্যাধমে আমাদের কথা বলতে আমাদের নিষেধ করে দেন। কালের কন্ঠ সরাসরি বুরহানকে ফোন করে একটা ইন্টারভিউ নেওয়ায় বুরহানকে যাচ্ছেতাই অপমান করেন।
-
পিপীলিকার পাশাপাশি আবু শোয়েবের তত্ত্বাবধানে "পেপারলেস এডমিশন" প্রজেক্টে যুক্ত থাকায় বুরহানের সাথে দুর্ব্যবহার করেন।
-
আমাদের (বুরহান ও চিশতী) নিজেদের প্রোজেক্টেই অন্য একজনের অধীনে চাকুরির প্রস্তাব দেওয়ার পরে আমরা সেটা প্রত্যাখান করলে বিভাগে রটান যে আমাদের টাকার লোভ বেশি এবং শুধু মাত্র বেশি বেতনের লোভের কারণেই আমরা পিপীলিকাতে যোগদান করি নি।
-
শুধুমাত্র সুপারভাইজার হিসেবে প্রোজেক্টে যুক্ত থাকার পরেও এর ওপর লেখা গবেষণাপত্রে নিজেকে প্রথম অথর (প্রধান লেখক) করার প্রস্তাব করা এবং রাজি না হওয়াতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তিতে গবেষণাপত্র লেখায় অসহযোগিতা করেন।
-
"অ্যাবস্ট্রাক্ট" লিখে পাঠানোর পর মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজের নাম আগে বসিয়ে দেন এবং উপযুক্ত ব্যাখ্যা জানতে দাবি করলে কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। পরবর্তীতে পেপার লিখা সম্পূর্ণ আটকে দেন ও এ জন্য মূল গবেষক দুই ছাত্র (চিশতী ও বুরহান)-কে দোষারোপ করেন।
-
পরবর্তীতে প্রোজেক্ট অর্থ বিনিয়োগ আসার পর সুযোগ থাকা স্বত্বেও দুই আবিষ্কারক বুরহান চিশতীকে কোন কাজে জড়িত না রেখে কৌশলে i) সোর্স কোড, ii) লোগো ডিজাইন, iii) ইন্টারনেট থেকে ক্রল করে কালেক্ট করা ডাটা- সবকিছুই হাতিয়ে নেন।
-
পরবর্তীতে ‘পিপীলিকা’ উদ্ভোদনের সময় মঞ্চ পিপীলিকার তখনকার শুধুমাত্র বেতনভুক্ত কর্মচারিদের ডেকে প্রদর্শন করেন এবং উপস্থিত থাকার পরেও বুরহান চিশতীকে কোন ধরনের স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। উপরন্তু তাদের শুধু মাত্র লোগো ডিজাইন ও নামকরনের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে সকলের সামনে অপমানিত করেন।
-
পরবর্তীকালে "ওরা কি পাবে? সব ডিপার্টমেন্টের" বলে এনডিএ-র ভয় দেখান। সাধারণত চাকুরিতে ঢুকলে এরকম নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট(এনডিএ) সাইন করতে হয়। শাবিপ্রবিতে আন্ডারগ্রাড থিসিস নিয়ে কোনো এনডিএ কার্যকর ছিল বলে আমাদের মনে পড়ে না।
-
বুরহান এবং চিশতীর ড্রপ কোর্স থাকায় সেই সুবিধা নিয়ে পরোক্ষভাবে ভয় ভীতি প্রদর্শন করেন।
-
পরবর্তীকালে বুরহান চিশতীর স্বীকৃতি বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অন্য কেউ কথা তুললে তাদের সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করেন।
-
৯ নম্বর পয়েন্টে সব ডিপার্টমেন্টের বললেও পরে ২০২০ এ এসে দ্বিমুখিতার চূড়ান্ত উদাহরণ দিয়ে ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন সজীব নিজেকেই প্রিন্সিপাল (মূল) আবিস্কাকর দাবি করে স্বত্ব চেয়ে শাবিপ্রবি সিএসই বিভাগকে ইমেইল করে উৎপাত করতে থাকেন।
-
সজীব নিজেকে (মূল) আবিস্কাকর দাবি করার ইমেইলটি তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান মারফত বুরহান চিশতীর হাতে আসলে এবং সোশাল মিডিয়ার অ্যালামনাই গ্রুপে তার পোস্টে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে উল্টো গালাগালি করে দুর্ব্যবহার করেন।
-
পরে ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন সজীব নিজেকে ভিক্টিম ও হয়রানির স্বীকার দাবি করে জল ঘোলা করে সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে (এটা তার একটা সাধারণ প্রচেষ্টা; যেটা আমরা পরবর্তীতেও দেখতে পাই)।
-
বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুরহান চিশতীর বিপক্ষে লিখতে প্রলুব্ধ করেন।
উপরের পয়েন্টগুলো পড়ে থাকলে আপনারা বুঝতে পারবেন: কী সুস্পষ্ট চক্রান্ত করে দিনের পর দিন একটু একটু করে মূল দুজন গবেষককে বাদ দিয়ে প্রোজেক্টের সব ক্রেডিট কুক্ষিগত করতে থাকে ‘শিক্ষক’ রুহুল আমিন সজীব। পরবর্তীতে কোটি কোটি টাকার প্রোজেক্টের প্রিন্সিপাল (মূল) আবিষ্কারক হিসেবে নিজের দাবি করার রাস্তা তৈরী করেন তিনি শুরু থেকেই। কীভাবে সার্চ ইঞ্জিনটি তৈরী হয়; এর বিস্তারিত ইতিহাস এবং কীভাবে রুহুল আমিন একে একে এটির বেদখল নিতে থাকে তার গল্প আছে পরের পর্বে।